ঢাকার বুকে গণহত্যার দৃশ্য দুরন্ত কিশোর শাহজামানকে পরিণত করেছিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুক্তিযোদ্ধায়। মরণপণ যুদ্ধের পুরো সময়টিতে জানতেও পারেননি তার মা ও বড় ভাইকে পাকিস্তানি হানাদাররা হত্যা করে ফেলে রেখেছিল বাড়ির পাশে একটি গর্তে।
প্রায় নিরাবেগ বিবরণীতে শাহজামান মজুমদার তাঁর কৈশোরের সেই আগুনঝড়া দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন। কোনো বাড়তি কথা নেই এখানে, নেই কোনো অতিশয়োক্তি। কিন্তু মহাকাব্যিক একটি যুদ্ধে যত রকমের ঘটনা ঘটতে পারে, যত রকমের মানবিক অনুভূতির পরিচয় পাওয়া সম্ভব, তার সবই মিলবে এই স্মৃতিকথায়। বেপরোয়া বীরত্ব, দুঃসাহসী সফল অভিযান অথবা যুদ্ধের বিপর্যয়কর মুহূর্তে সঙ্গীদের রক্ষার জন্য নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি গ্রহণের মতো অবিস্মরণীয় কাহিনি এখানে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সন্দেহ আর বিশ্বাসঘাতকতার, ভীরুতার বহু চিত্র। তেলিয়াপাড়াসহ আরও কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিবরণ এই গ্রন্থটিকে দিয়েছে বাড়তি তাৎপর্য। পাঠকের সাথে এই বইতে সাক্ষাৎ ঘটবে আমাদের ইতিহাসের অনেকগুলো পরিচিত মুখের, একই সাথে পাঠক জানবেন দুলামিয়ার মত ইতিহাসে নাম-না-লেখা-থাকা বীরদের বীরত্বগাঁথাও।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক স্মৃতিচারণমূলক সাহিত্যের ইতিহাসে এক কিশোরের মুক্তিযুদ্ধ একটি অবিস্মরণীয় কীর্তি হিসেবেই বিবেচিত হবে।
শাহজামান মজুমদার (১৯৫৬-২০২০) কৈশোরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। দিনাজপুরের কালিতলা এলাকায় জন্ম। পিতা রজব আলী মজুমদার এবং মাতা সায়েরা মজুমদার। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী যখন বাংলার মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। প্রশিক্ষণ নেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং তিন নম্বর সেক্টরের অধীনে আখাউড়ায় পাকবাহিনীকে প্রতিহত করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব পান। একাত্তরের এপ্রিলে হবিগঞ্জের বিখ্যাত তেলিয়াপাড়ায় যুদ্ধে অংশ নেন।
শাহজামান মজুমদার পাকিস্তানি বাহিনীর সাঁজোয়া যান ধ্বংসের ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে অংশ নেন। সহযোদ্ধাদের সাথে অ্যান্টি ট্যাংক মাইনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত্রুকে পরাজিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন বইয়ে, পত্রিকায় ও সাক্ষাৎকারে।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এটি বাংলা ভাষায় শাহজামান মজুমদারের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিকথা।